বরাক উপত্যকা নাগরিক সমাজের আবেদন
📌বরাক উপত্যকার নাগরিক সমাজের আবেদন
------------------------------------------------
নয়া ঠাহর ,সংবাদদাতা: শিলচর
ভাষা ও জাতিসত্তার উপর আক্রমণ মানছি না, মানব না
সুধী বরাকবাসী,
আমাদের জাতীয় আদিপাপ হিসেবে গণ্য দেশভাগের ফলে বহু উপভাষা ও বিভাষার সমৃদ্ধি সম্পন্ন বাংলা ভাষা এবং খণ্ডিত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থানকারী বাংলাভাষী বাঙালি অভূতপূর্ব বিপন্নতার মুখোমুখি। গত কিছুদিনে প্রমাণিত হয়ে গেছে, দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির ৭৮ বছর পরেও রাষ্ট্রশক্তি বাঙালি-বিদ্বেষকে অঙ্গারের মতো জ্বালিয়ে রেখেছে। বিশেষভাবে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি রাষ্ট্রতন্ত্র ভাষিক আধিপত্যবাদকে নিজেদের প্রধান নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে সংবিধান অবমাননা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুভাষিক এই দেশে কোনো একটি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্দিষ্ট না হলেও বছরের পর বছর ধরে অপপ্রচার করে মিথ্যাকেই প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলা সহ অসমিয়া-মণিপুরি-তামিল-তেলেগু-মারাঠি-মালয়ালম প্রতিটি ভাষাই রাষ্ট্রভাষা। এদের সঙ্গে গুজরাটি বা হিন্দি সহ সমস্ত ভাষাই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়া উচিত। কিন্তু তার বদলে সুপ্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে পদদলিত করে রাষ্ট্রশক্তি বাঙালি-বিদ্বেষকে হিংস্র ঘৃণা ও আক্রোশের গিলোটিনে পরিণত করতে চেয়েছে। তাই ভারতীয় ভাষার বিজ্ঞান-সম্মত ধারণাকে জলাঞ্জলি দিয়ে শাসকদলের ঢোল-বাদক এক ব্যক্তি বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করেছে। বাংলাভাষী বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও ভাষা-গণতন্ত্রে বিশ্বাসী অবাঙালি সচেতন জনেরাও চরম ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ও স্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে বদ্ধপরিকর বরাক উপত্যকার সমস্ত সচেতন বাংলাভাষীও সঙ্গত কারণেই তীব্র অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশকে প্রত্যাখ্যান করছেন।
বস্তুত কয়েক প্রজন্ম ধরে আমরা যে রবীন্দ্রনাথ পরিকল্পিত ধ্যানের ভারত গড়ে তুলেছি, তাকেই ধ্বংস করার চক্রান্ত এখন রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদতে সাধারণ ভাবে ভাষা গণতন্ত্র এবং বিশেষভাবে বাংলাভাষী জনগণের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে আমরা একচক্ষু হরিণের ভূমিকা নিতে পারি না। মহাবিনাশের সার্বিক আয়োজন যখন চরম দুঃসময়ের বার্তা নিয়ে এসেছে, আমাদের ধ্রুবপদ হোক : বাঙালি জাতির একমাত্র গোত্রলক্ষণ তার অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি। শ্রীহট্টীয় সহ বিভিন্ন উপভাষা আমাদের সমৃদ্ধির প্রমাণ। সেইসঙ্গে আমরা চক্রান্তকারীদের উদ্দেশে স্পষ্টভাবে জানাচ্ছি ভাষাবিজ্ঞানের বিধি অর্থাৎ উচ্চারণতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যগঠনতত্ত্ব, শব্দার্থতত্ত্ব প্রভৃতি সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ না জেনে যারা আমাদের উপভাষা এবং সমৃদ্ধ ভাষিক পরিচয়কে অপমান করতে চায়, তারা প্রকৃতপক্ষে ভারতের সংহতির মূলেই কুঠারাঘাত করে। কিন্তু অসূয়াপ্রবণ জাতি-বিদ্বেষীদের হিংস্র আক্রমণ আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। তাই বিকার ও বিদূষণ-সর্বস্ব অপশক্তিকে যেকোনো মূল্যে আমরা প্রতিহত করবই।
এই মুহূর্তে নানা কারণে দেশ যখন বহুমুখী সংকটের মোকাবিলা করছে, সে সময় বাংলা সহ সমস্ত রাজ্যভাষার মর্যাদা রক্ষা করাই আমাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সামূহিক দায়িত্ব। অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তের কাছে কোনো গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ আত্মসমর্পণ করতে পারেন না। জাতিসত্তাকে প্রত্যক্ষ সত্যের মতো অনুভব করার সামর্থই আমাদের মুক্তি দিতে পারে। সেইজন্যে বাংলাসহ সমস্ত ভারতীয় ভাষার সমমর্যাদার ভিত্তিতে নতুন দেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার আমরা গ্রহণ করছি। মনে রাখছি, বিবিধ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ শ্রীহট্টীয় ও অন্যান্য উপভাষা কোনো কুচক্রীর উদ্ধত অপপ্রচারে যেমন মিথ্যা হয়ে যায় না— তার চেয়ে অনেক বড় সত্য হল : বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, অবনীন্দ্রনাথ, শহীদুল্লাহ, নীহাররঞ্জন রায়-এর বাংলা ভাষা অভিন্ন জাতিসত্তার অভিব্যক্তিতে দেদীপ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে। এই ভাষাকে যারা আক্রমণ করে, তারা নিজেরাই চূর্ণ হয়ে যাবে। বাংলাদেশে এবং ভারতের নানা প্রান্তে যারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, অজস্র স্থানিক বৈচিত্র্য সত্ত্বেও, তাঁরা প্রত্যেকেই বাঙালি। 'বাংলাদেশি' ভাষা বলে কিছু কোথাও নেই। অজ্ঞতার সঙ্গে যখন দুরভিসন্ধি যুক্ত হয়,তখন পাগলের প্রলাপ তৈরি হয়। কিন্তু সেইজন্যে একে লঘুভাবে দেখলে ভয়ানক ভুল হবে।
তাই আসুন, আমরা এই সংকটের প্রহরে নতুনভাবে বাঙালি জাতির হওয়া এবং হয়ে ওঠার ধারাবাহিক ইতিহাস খুঁজে নিই। আমাদের চেতনাকে জাগিয়ে রাখার সোনার কাঠি জোগান দিক দৃঢ় ঐক্যের বোধ। একে অন্যকে আহ্বান জানাই, 'আসুন মায়া ছড়াই'। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাণীই হোক এ সময়ের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার : 'বাঙালি বাংলায় জন্মেছে বলেই সে বাঙালি তা নয়। বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের চিত্তলোকে যাতায়াতের বিশেষ অধিকার তৈরি হয়েছে বলেই সে বাঙালি'। (সাহিত্যের পথে : রবীন্দ্ররচনাবলী , চতুর্দশ খণ্ড , পৃ: ৩৭৭)
এবং 'আমরা একই জাতি সুখে-দুঃখে আমাদের এক দশা এবং পরষ্পরকে পরমাত্মীয় বলিয়া না জানিলে ও অত্যন্ত কাছে না টানিলে আমাদের
কিছুতে মঙ্গল নাই।' (আত্মশক্তি ও সমূহ : রবীন্দ্ররচনাবলী : দ্বাদশ খণ্ড : পৃঃ ৮১৩)
আসুন, জাতিসত্তাকে চিরজাগ্রত রেখে আমরা নতুন করে যৌথ জীবনকে স্বপ্ন করে তুলি, স্বপ্নের মধ্যে বাঁচি। এমন বাঙালি খাঁটি বাঙালি হয়েই সংকটগ্রস্ত ভারতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ববোধের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরি। বাঙালি-বিদ্বেষী কুচক্রীরা আমাদের যে-পরীক্ষার মুখোমুখি করেছে, বরাক উপত্যকার সংগ্রামী মানুষরা ভাষা-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে তার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিক।
আসুন সমস্বরে বলি : 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর...'
বিনীত
ড. তপোধীর ভট্টাচার্য
অধ্যাপক দিলীপ কুমার দে
তৈমুর রাজা চৌধুরী
মিথিলেশ ভট্টাচার্য
ড. দেবাশিস ভট্টাচার্য
নির্মল কুমার দাস
সঞ্জীব দেবলস্কর
মন্দিরা নন্দী
নীতিশ ভট্টাচার্য
শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার
গৌতম প্রসাদ দত্ত
পরিতোষ চন্দ্র দত্ত
ড. স্বপন পাল
ড. সীমা ঘোষ
বিশ্বজিৎ দাস
তমোজিৎ সাহা
ড. মুজিব স্বদেশি
দিলীপকান্তি লস্কর
ড. সুশান্ত কর
স্বপ্না ভট্টাচার্য
কমল চক্রবর্তী
মশহুরুল বারী
সুব্রত কুমার পাল (আইনজীবী)
আতিকুর বারি চৌধুরী (আইনজীবী)
শিখা ভট্টাচার্য
সুকল্পা দত্ত
জ্যোতিরিন্দ্র দে,
উত্তমকুমার সী
আদিমা মজুমদার
স্নিগ্ধা নাথ
মনোতোষ চক্রবর্তী
জয়ন্ত চৌধুরী
মানস দাস
শুভব্রত দত্ত
সুজিৎ দাস
আশিসরঞ্জন নাথ
সব্যসাচী রুদ্রগুপ্ত
জিতেন্দ্র নাথ
শঙ্করজ্যোতি দেব
কাঞ্চনবরণ সিংহ
মঞ্জরী ভট্টাচার্য
খলিল আহমেদ মজুমদার
রত্নদীপ দেব
জয়শ্রী ভূষণ
বাহার উদ্দিন
কল্পার্ণব গুপ্ত
তানিয়া লস্কর(আইনজীবী)
শহিদুল হক
তৌহিদ খান
দেবরাজ দাশগুপ্ত
অমল গুপ্ত
প্রদীপ্ত পুরকায়স্থ
বিবেকানন্দ মহন্ত
প্রদীপ নাথ
মৃত্যুঞ্জয় দাস
অনিমেষ ভট্টাচার্য
অদিতি চক্রবর্তী
দেবাশিস চন্দ
Comments
Post a Comment