বাংলাদেশি ,বাঙালি ইত্যাদি বলে বলে অনুপ্রবেশ কারীরা ভারতীয় নাগরিক হয়ে যাচ্ছে

এক বাঙালি বলছি, বাংলায় বলছি ।

মোটামুটি যা বুঝলাম, ২০২৬-এ রাজ্যে বিধানসভা ভোট নয়, ভাষা আন্দোলন হবে । কারণ দেশজুড়ে, বিশেষত বিজেপি শাসিত সব রাজ্যে, নাকি বাংলার বিরুদ্ধে ভাষা-সন্ত্রাস চলছে । 

আমি একজন গর্বিত বাঙালি, বাংলায় অনার্স । সেই সুবাদে বাংলা ভাষা নিয়ে অল্প বিস্তর পড়াশুনোর সৌভাগ্যও হয়েছে । দীর্ঘ ২৫ বছর বাংলায় থেকে, বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতা করেছি । ফলে বাংলা ভাষা আমার পেটের ভাতও যোগায় । ৪ বছর হল, চাকরি সূত্রে আমি প্রবাসী । কাজের প্রয়োজনে গোটা দেশ ঘুরতে হয় । বর্তমানে আমি যে তিন রাজ্য দেখভালের দায়িত্বে, ঘটনাচক্রে সেই তিন রাজ্যেই বিজেপি সরকার । মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, অসম । বাংলার ওপর ভাষা-সন্ত্রাস চলছে এবং আপামর প্রবাসী বাঙালি সেই সন্ত্রাসের শিকার, এমন কোনও কাণ্ড আমার অন্তত নজরে পড়েনি । 

নয়ডাতে একটি প্রকাণ্ড টাওয়ারে ৮টি তলা নিয়ে আমাদের অফিস । আমি যে তলায় বসি, মজা করে আমরা বলি, 'হিন্দি হার্ট ল্যান্ড' । কারণ, এই তলাতেই আমাদের বিহার-ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ-ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ-উত্তরাখণ্ড এবং রাজস্থান চ্যানেলের নিউজ ফ্লোর । সব সম্পাদক আর সহকর্মীর সঙ্গেই আমার মাখামাখি সম্পর্ক । এই তলায় পাতা নড়লেও আমি খবর পাই । বেশিরভাগই বিজেপি শাসিত রাজ্য । কই, এমন কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের খবর নেই তো ! কর্মসূত্রে প্রায় ৬ বছর হায়দরাবাদে থেকেছি । ২০২৩ প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছি বেঙ্গালুরুতে । দুই শহরেরই বাঙালি সমিতির কর্তা থেকে সদস্য, সবার সঙ্গে আমার নিত্য যোগাযোগ । কেউ আমাকে এমন ভাষা-সন্ত্রাসের কথা জানাননি তো ! নয়ডাতে আমি যে সোসাইটিতে থাকি, সেখানে ২০০ ঘর বাঙালির বাস । এই তো কালই আমরা হই হই করে দুর্গাপুজোর জন্য মিটিং করলাম । বাংলায় কথা বললাম, হো হো করে হাসলাম, টেবিল চাপড়ে তর্ক করলাম । কই, যোগী রাজ্যের কেউ এসে সন্ত্রাস চালালো না তো ? আমার ফেসবুক পেজে বহু প্রবাসী বাঙালি বন্ধু আছেন । সবার কাছে অনুরোধ, আপনারা যে রাজ্যে থাকেন, সেখানে এমন কোনও ভাষা-সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন কিনা, প্লিজ জানাবেন । 

আসলে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে, পুলিশের হাতে ধরা পড়া, বাংলাভাষী অথচ অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সমস্যাকে আপামর বাঙালির সমস্যা বলে চালানো হচ্ছে না তো ? তাহলে তা বিপজ্জনক । 

কিন্তু দেশজুড়ে, হঠাৎ করে, অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার অভিযানই বা শুরু হয়েছে কেন ? এর প্রেক্ষিতটা বুঝতে হবে । এর পিছনে আসলে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের অস্তিত্বের সংকট । বিষয়টি বুঝতে হলে, নীচের তালিকার যে কোনও একটি শহরে পৌঁছে যান । 
১. এনসিআর মানে ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিওন । এর মধ্যে রয়েছে দিল্লি, নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা, গুরগাঁও ও গাজিয়াবাদ । 
২. মুম্বই, পুণে, নাসিক । 
৩. বেঙ্গালুরু । 
৪. হায়দরাবাদ । 
৫. চেন্নাই । 
৬. কোচি, এর্নাকুলাম । 
৭. সুরাত ।
৮. ভুবনেশ্বর, কেন্দ্রপাড়া, ভদ্রক ।
এই শহরগুলিতে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক গিজ গিজ করছেন । কী কাজ করেন এঁরা ? এঁরা সবাই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক । নির্মাণ শ্রমিক, প্লাম্বার, জরি বা গয়নার কাজ করেন । তবে বিরাট অংশই নির্মাণ শ্রমিক । কোথা থেকে আসেন এঁরা ? মূলত মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, হাওড়া । তবে গত কয়েক বছরে দুই চব্বিশ পরগণা, নদীয়া এবং বীরভূম থেকেও পরিযায়ী শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন । 

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি । নয়ডাতে যত টোটো চালক, সবজি বিক্রেতা, তার বড় অংশই বাংলাভাষী । এঁদের স্ত্রীরা বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করেন । বহুদিন ধরেই এঁদের কাছে শুনছি কী ভাবে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিরা এঁদের কাজ নিয়ে নিচ্ছে । আমি মুর্শিদাবাদের ছেলে । নয়ডার শয়ে শয়ে নির্মীয়মান বিপুল সব সোসাইটিতে আমি মাঝে মাঝেই যাই । সব মুর্শিদাবাদের শ্রমিক, গরিব মুসলিম । এঁদের সঙ্গে আমার মুর্শিদাবাদের ডায়ালেক্টে কথা বলতে আমি যাই । আমার প্রাণের ভাষা । এঁরাও আমায় একই কথা বলেছেন । কী ভাবে অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা এঁদের রুজিতে হাত দিচ্ছে । পুলিশকে টিপ অফ এঁরাই দিচ্ছেন । ভাবুন, ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা এখন সন্দেহজনক বাংলাভাষী বাংলাদেশী দেখলেই পুলিশে খবর দিচ্ছে । ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখুন, বাম শাসিত কেরালায় ২৭ জন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীকে ধরিয়ে দিল কারা । বাংলায় অস্তিত্বের সংকটে পরে ভিনরাজ্যে পেটের ভাত জোগাড় করতে গিয়ে সেখানে ফের নতুন করে সংকটে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা । 

তাই শুদ্ধ বাংলা প্রেম দেখাতে হলে, শুদ্ধ বাঙালিকে বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত । বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বাংলার সব রকম জাল পরিচয়পত্র কোন দালাল চক্র পাইয়ে দিচ্ছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা উচিত । বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করতে কেন্দ্র সরকারকে সব রকম সাহায্য করা উচিত । 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করা উচিত, যে রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার বইছে সেই রাজ্য ছেড়ে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে ভিন রাজ্যে কাজ খুঁজতে কেন যেতে হচ্ছে ? মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরের তস্য গরিব মুসলমানের শাসক দলের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য সত্ত্বেও কেন তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না ? 

বিকাশ সরকার নামে এক হতভাগ্য বাঙালি পরিযায়ীর গল্প বলে এই লেখা শেষ করব । ১০ই জুন, ২০২৩ । নয়ডাতে আমার ফ্ল্যাটের বাথরুম পরিষ্কারের জন্য আরবান কোম্পানির সার্ভিস বুক করেছি । নির্দিষ্ট সময়ে এলেন দু'জন । তাঁদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমি ফোনে কারও সঙ্গে বাংলায় কথা বলছিলাম । হঠাৎ ওই দু'জন বেরিয়ে এলেন, চোখ চকচক করছে । "দাদা তুমি বাঙালি ?" আমি স্তম্ভিত ও লজ্জিত । কোনও কাজই ছোট নয় । তবুও ঘর ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে আমার এই দুই ভাই এত দূরে এসে বাথরুম সাফ করে পেট চালাচ্ছে ! আমার হতভাগা রাজ্যে সামান্য এ কাজটুকুও তাদের জোটে না ! বিকাশ দক্ষিণ দিনাজপুরের মানুষ । 

ভিন রাজ্যে শুদ্ধ বাঙালি ও ভারতীয় পরিযায়ী এই সব বিকাশদের বাঁচাতে হলে অনুপ্রবেশ রুখতে হবে । না হলে বাংলার মাটি থেকে বহু দূরে প্রবাসে বাংলার গৃহযুদ্ধ হবে । সেদিন দূরে নয় ।

 - ধ্রুবজ্যোতি প্রামাণিক
    (সাংবাদিক)

*শুভ রাত্রি*

Comments

Popular posts from this blog

মহালয়ার পবিত্র তিথিতে প্রকাশ পাবে বাংলা শারদ সংখ্যা নয়া ঠাহর

শুভ মহালয়া তিথিতে ১৮ তম "নয়া ঠাহর পুজো সংখ্যা প্রকাশ

প্রণব আচার্য্য লিখিত বৈষ্ণব গ্রন্থ প্রকাশ